বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া মুসলিম নগরীর স্মৃতি স্মারক মাহীসন্তোষ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ
সুপ্রাচীন কাল হতে রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার মাহীসন্তোষ এলাযেটিজ প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদ ছিল বলে ধারণা করা হয়। মুসলিতে থাকে। সমৃদ্ধির ধারা মোগল আমলের শেষ পর্যায় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। সামরিক, প্রশাসনিক ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উত্কৃষ্ট কেন্দ্র হিসেবে ইতিহাসে মাহীসন্তোষ সমধিক খ্যাতি লাভ করে।
সুলতান রোকনুদ্দিন বারবাক শাহ এর আমলে এই সমৃদ্ধিকে আরো উচ্চতা দান করেন। তিনি মাহীসন্তোষে একটি টাকশালও প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নামানুসারে অঞ্চলটি বারবাকাবাদ নামেও পরিচিতি লাভ করে। মুসলিম আমলে গড়ে ওঠা প্রশাসনিক ভবন, সাধারণ ভবন, মাদরাসা, মসজিদ ও খানকার বেশির ভাগ কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও মাহীসন্তোষের বারোদুয়ারি মসজিদটি এখনো কালের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে।
পরিচ্ছে সূচীঃ
- অবস্থান
- মাহিসন্তোষ সমৃদ্ধির প্রেক্ষাপট
- ধর্ম চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মাহীসন্তোষ
- ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ
- টাকশাল হিসেবে মাহিসন্তোষ
- মাহিসন্তোষ নামকরণের সার্থকতা
- নদীবন্দর ও অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে মাহিসন্তোষ
- সামরিক ঘাঁটি হিসেবে মাহীসন্তোষ
- মাহিসন্তোষ গড়ের ঐতিহ্যবাহী সরুপ
- মাহিসন্তোষ গড়ের প্রত্নতত্ত্ব বিশ্লেষণ
- বীরত্ব রূপে মাহিসন্তোষ
- মোঘল আমলে মাহিসন্তোষ
- মাহিসন্তোষ গড়ের প্রত্নতত্ত্ব বিশ্লেষণ
- সম্পত্তির পরিমাণ
- স্থাপত্য
- বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া মুসলিম নগরীর স্মৃতি স্মারক, মাহীসন্তোষ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ
আরও পড়ুনঃ হাইব্রিড টমেটো কি জিনগতভাবে পরিবর্তিত হয়
অবস্থান
নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলা হতে ১০ (দশ) কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ- ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে আত্রাই নদীর পূর্ব দিকে প্রায় ১ (এক) কিলোমিটার দূরে হিন্দু বৌদ্ধ শাসনামলে গড়ে উঠেছিল এই প্রসিদ্ধ মাহীসন্তোষ নগরী।
মাহিসন্তোষ সমৃদ্ধির প্রেক্ষাপট
মাহিসন্তোষের সমৃদ্ধির সূত্রপাত হয় বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয়ের মধ্যে দিয়ে। এবং এটি সুলতানি যুগ পর্যন্ত বিস্ত্রত ছিল। যার ধারাবাহিকতা পরিলক্ষিত হয় মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকাল পর্যন্ত। মাহিসন্তোস বিভিন্ন নামে অভিহিত হয় মুয়ালিম শাসনামলে। লক্ষণ সেনের রাজধানী লক্ষণাবতি গৌড় অধিকারের পরেই বখতিয়ার খিলজি দেবকোটে (গঙ্গারামপুরের সন্নিকোটে) রাজধানী স্থান্তর করেন।
ধর্ম চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে মাহীসন্তোষ
বঙ্গ বিজয়ের সাথে সাথেই ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মাদ বখতিয়ার খিলজির রাজধানী গৌড় হতে স্থান্তর এবং নতুন রাজধানী দেবকোটের নিকট মাহীসন্তোষ দুর্গনগরে ইস্লামী শাসন ব্যবস্থার শুভো সূচনা হয়। ইসলামী শিক্ষার শুরুতে খানকা, মসজিদ এমনকি আস্তানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে ছিল। এরপর আস্তে আস্তে মসজিদ কেন্দ্রিক মাদ্ররাসা ও মকতব শিক্ষা প্রতিষ্ঠন হিসাবে গড়ে উঠে। মাহীসন্তোষ গড়ের মাদ্রাসাটি ছিল সুলতানি আমলের অন্যতম বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
মাদ্রাসাটির প্রধান বিশিষ্ট সুফি- সাধক, পীর ও দরবেশের মর্যাদাসম্পন্ন জ্ঞানতাপস হযরত তাকিউদ্দীন আল- আরাবীর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে দেশ- বিদেশের শিক্ষার্থীরা মাহিসন্তোষ মাদ্রাসায় সমবেত হতো জ্ঞান অর্জন ও সুফি চর্চার উদ্দেশ্যে। ফলে দেশ জোড়া প্রসিদ্ধ একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্টিত হয় এখানে।ইতিহাস প্রসিদ্ধ মাহীসন্তোষ মাদ্রাসার প্রতিষ্টাতা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ সুফি সাধক ''মাওলানা তাকিউদ্দীন আল- আরাবী'' যার নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণক্ষরে লিখা আছে।
আলোচ্য মাদ্রাসার প্রতিষ্টাতা মাওলানা তাকিউদ্দীন আল- আরাবীর প্রধান শিস্য সুফি সাধক বিহারের সায়খ মখদুল আল- মূলক শরফুদ্দিন ইয়াহিয়া মানোরীর পিতা সুফি শায়খ ইয়হিয়া মানেরী। উত্তর- পশ্চিম বাংলায় ইসলাম ধর্ম বিশেষ মর্যাদা পায় পান্ডুয়ার প্রখ্যাত সুফি দরবেশ কুলের শিরোমনি নূর কুতুল উল আলম এর প্রচেষ্টায়।
ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ
অধিকৃত উত্তর- পশ্চিম বাংলার রাজ্যকে ইক্তা নামের চারটি এলাকায় বিভক্ত করে বখতিয়ার খলজি, খলজি মালিকদের মধ্যে ৪ জনকে মুক্তা পদে নিয়োগ দেন। বখতিয়ার খিলজি মাত্র দুই বছরের মধ্যে আতাতিয়ার হাতে নিহত হলে খলজি মালিকদের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ব্যক্তি নজেকে সুলতান হিসাবে ঘোষণা করেন শিরান খিলজি। এই নগরি মুসলিম শাসনকালে মাহীসূন ও মকসিদাহ সন্তোষ নামে পরিচিত ছিল।
টাকশাল হিসেবে মাহিসন্তোষ
মাহীসন্তীষ নগরীর নতুন নামকরণ করা হয় সুলতান রুকুন উদ্দীন বারবাক শাহের নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ''সরকার বারবকাবাদ'। বারবকাবাদ নগরিতে প্রশাসনিক ভবন- অট্টালিকাসহ মুদ্রা ছাপানোর আয়োজনের মাধ্যমে "টাকশাল নগরীর'' মর্যাদা লাভ করে মাহীসন্তোষ। এই টাকশাল হতে উৎকীর্ণ সাতটি মুদ্রা পাওয়া যায়। যার মধ্যে ১টি তাম্র মুদ্রা এবং ৬টি রৌপ্য মুদ্রা।
মাহিসন্তোষ নামকরণের সার্থকতা
হিন্দু, বৌদ্ধ প্রভাবমুক্ত মুসলিম যুগে ইস্লামি দৃষ্টিভঙ্গি হতে মায়িসন্তোষ বা মাহীসন্তোষ নামে অভিহিত করণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কতিথ আছে যে, একজিন্সূফির আগমন ঘটেছিল মাছের পিঠে সওয়ার হয়ে। ফারসী ভাষায় মাহী শব্দের বাংলা মাছ। বিভিন্ন নিবন্ধে মায়িসন্তোষ বা মাহীসন্তোষ শব্দের ব্যবহার করেছেন উনিশ শতকে ইংরেজ গবেষক সহ প্রখ্যাত ঐতিহাসিকগণ। স্থানীয় লোকেরা এখন ঐতিহাসিক মাহীসন্তোসকে মাহীগঞ্জ বলেই জানে।
নদীবন্দর ও অর্থনীতির কেন্দ্র হিসেবে মাহিসন্তোষ
প্রাচীন কালে আত্রাই নদীর পলি বাহিত এই জনপদে প্রচুর পরিমাণে ধান, গম, ইক্ষু পাট, তুলাসহ সকল প্রকার কৃসিজাত উৎপন্ন ও ক্রয় মিক্রয় এর জন্য গড়ে উঠা মাহীসন্তোষ বন্দরটি কালক্রমে একটি প্রসিদ্ধ নৌবন্দর হসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
সামরিক ঘাঁটি হিসেবে মাহীসন্তোষ
দিগ্বিজয়ী বীর,মহাপরাক্রমশালী, প্রজারঞ্জক, মহানুভব রাজা মহীপালের রাজত্বকালেই মাহীসন্তোষ নগরী প্রতিষ্টিত হয়েছিল,এ বিষয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত পোষণ করেছেন। পাল রাজবংশের হৃত রাজ্য বঙ্গের রাজধানী গৌড় পুনরুদ্ধার করার পর কৌশলগত কারণেই তিনি মাহীসন্তোষে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে বরেন্দ্র এলাকায় তাঁর শাসনের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিলেন।
মাহীসন্তোষ গড়ের গুরুত্ব সম্পর্কে সুলতানি শাসন আমলে ইতিহাসে অনেক তথ্য জানা যায় পাল ও সেন যুগ অবসান হলে। বখতিয়ার খিলজী তাঁর রাজধানী মালদহের লখনৌতি গৌড় থেকে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গের প্রসিদ্ধ গঙ্গারামপুরের সন্নিকটে অবস্থিত দেবকোটে (বর্তমানকালের দমদমা) স্থানান্তরিত করেন।
দেবকোট হতে ৫ (পাঁচ) কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত মাহীসন্তোষ দুর্গ তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর শিরান খলজী এবং তিনি নিজে তত্ত্বাবধায়ন করতেন। আলী মর্দান খিলজী কর্তৃক বখতিয়ার খিলজী নিহত হলে সুলতান নির্বাচিত হন শিরান খলজী। আলী মর্দান খিলজীর ষড়যন্ত্রের শিকার হন তখন তিনিও। আলী মর্দান খিলজীর কথায় দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন তখন শিরান খিলজীর বিরুদ্ধে অযোধ্যার শাসনকর্তা কায়েমাজ রুমীকে প্রেরণ করেন।
যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিরান খিলজী সুরক্ষিত মাহীসন্তোষ দুর্গে আত্মগোপন অবস্থায় খিলজী মালিকদের অন্তর্দ্বন্দ্বে নিহত হন তাকে এখানেই সমাহিত হন। সুলতানি শাসনাকালে মাহীসন্তোষ গড় দুর্গে স্মরণীয় এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শাহী বংশের সেনাপতি গাজী ইসমাইল এবং পরাক্রমশালী কামরুপ রাজ কামেশ্বরের সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
সেনাপতি গাজী ইসমাইল সম্ভবতঃ কামরূপ রাজ্য বিজয়ের জন্য তিনি যুদ্ধ অভিযানে পিছু হটেন এবং শত্রু পক্ষকে প্রতিহত করার জন্য আশ্রয় গ্রহণ করেন সুরক্ষিত মাহীসন্তোষ দূর্গে। এই যুদ্ধে ১২০ (একশত বিশ) জন মুসলিম সৈন্য নিহত হন এবং এখানেই তাদেরকে সমাহিত করা হয়। প্রাচীরে ঘেরা বারোদুয়ারী মসজিদ এর নিকটে উত্তর দিকে কবরটি নিহত বীর সেনাদের গণকবর। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ নিয়ে অনেক মধ্যে মতভেদ আছে যে, রাজধানী পান্ডুয়া হতে অনেক দূরে মাহীসন্তোষে যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার কি কারণ সম্পর্কে।
পরবর্তী সময়ে পাল্টা আক্রমণ করেন ঘোড়াঘাট দূর্গে ফলে দিশেহারা কামেশ্বর রাজা, মুসলিম এই বীর সেনাপতি ইসমাইল গাজীর বীরত্বে দেখে ও আধ্যাত্মিক তাঁর গুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁর নিজের ধর্ম ছেড়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। একেশ্বরবাদ ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে কামরূপ কামাখ্যার রাজাসহ সামরিক-বেসামরিক সর্বস্তরের লোকেরা আশ্রয় গ্রহণ করে পৌত্তলিক ধর্ম ত্যাগ করে ।
মাহিসন্তোষ গড়ের ঐতিহ্যবাহী সরুপ
সুদূরপ্রসারী ছিল মাহীসন্তোষ গড়ের যুদ্ধের ফলাফল। এই যুদ্ধের ধারাবাহিকতার ফলে ঘোড়াঘাটে সংগঠিত যুদ্ধের পর কোচবিহার, রংপুর, কামরূপসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গে মুসলিম বিজয় হয়। জিন্দাপীর খ্যাত, গাজী উপাধি পাপ্ত মুসলিম সাম্রাজ্য বিস্তারকারি ও পতাকাবাহী বীর সেনাপতিকে মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে ঘোড়াঘাট দুর্গে সুলতানের আদেশে তাঁর শিরচ্ছেদ করা হয়।
জনশ্রুতি আছে যে, কাঁটাদুয়ারে গাজীর খন্ডিত মস্তক, ইসমাইল পুরে হস্ত, গড় মান্দারণে ছিন্ন পদযুগল নিক্ষিপ্ত করা হয় এবং ঘোড়াঘাট যুদ্ধক্ষেত্রে দেহ পড়ে থাকে। পীর ইসমাইল গাজীর মাজার এই সকল স্থানে রয়েছে সেখানে মুসলিম- হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে পবিত্র স্থান। উক্ত স্থানের চারটি মাজার বর্তমান সময়ে জিয়ারত, পূজা ও মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের কেন্দ্র স্থল হিসাবে গণ্য হয়।
বীরত্ব রূপে মাহিসন্তোষ
কিংবদন্তির মহাপুরুষ গাজী ইসমাইলের বীরত্বগাথা ইতিহাসের এক বিশাল উপাখ্যান। সংক্ষিপ্ত পরিসরে বলা প্রয়োজন যে, অসাধারণ সাধু চরিত্র ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান সম্পন্ন সাধক রূপে ইসমাইল গাজীর যেমন দেশজোড়া সুনাম ছিল।
তদ্রূপ ন্যায়নীতি পরায়ন,পরোপকারী মহান শাসক রূপেও তাঁর খ্যাতি কম ছিল না। এজন্য জনশ্রুতি ও বিশ্বাসের রাজ্যে তিনি এমন একজন সক্ষম সামরিক পুরুষ যিনি যুগপৎভাবে অসাধারণ মাহাত্মে বুজুর্গ সুফী সাধকের মহিমায় পরিচিত এবং মরণোত্তর জীবনে একজন মহান পীরের দুর্লভ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।
মোঘল আমলে মাহিসন্তোষ
মোগল শাসনামলেও সরকার বারবকাবাদ এর মর্যাদা অক্ষুন্ন ছিল। যুগ শ্রেষ্ঠ মহামতি সম্রাট আকবরের দিওয়ান রাজা টোডরমল ১৫৮২ সালে বাংলাদেশকে ১৯টি ও বিহারকে ৫টি মোট ২৪টি সরকারে বিভক্ত করেন। তন্মধ্যে পরগনা সন্তোষ কেন্দ্রীক সরকার বারবকাবাদ অখন্ড দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া জেলা এবং পাবনা ও বৃহত্তর রাজশাহী জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল।
মুঘল শাসনামলে মাহীসন্তোষ দুর্গের বারবকাবাদ সরকার দিল্লিকে ৫০ (পঞ্চাশ) টি মতান্তরে ৫০০ (পাচশত) টি অশ্ব এবং ৭০০০ (সাত হাজার) পদাতিক সৈন্য সরবরাহ করতো। সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম সদস্য ও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল রচিত প্রসিদ্ধ "আকবরনামা" গ্রন্থের বর্ণনা থেকে এসব তথ্য জানা যায়। সম্রাট আকবরের শাসনকালে ১৫৭৬ সালে রাজমহলের যুদ্ধে বাংলার শেষ সুলতান দাউদ কাররানীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে উত্তর ও পশ্চিম বাংলা মোগল সাম্রাজ্য ভুক্ত হয়।
সুলতানি শাসনামলেই বাংলাদেশে স্বাধীন জমিদারি প্রথা শুরু হয়। জমিদারদের মধ্যে বারো ভূঁইয়াদের নেতা ইশা খানের সেনাপতি ১৫৮৩ সালে উত্তর পশ্চিম বাংলার তৎকালীন রাজধানী তান্ডা ও মাহীসন্তোষ দুর্গ দখল করে এবং অনতিকাল পরেই মোগলরা ঈসা খানের বাহিনীকে প্রতিহত করে রাজধানী তান্ভা ও মাহীসন্তোষ দুর্গের দখল পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে।
মাহীসন্তোষ বারো দুয়ারী মসজিদের উত্তর-পূর্ব দিকে ও মিঠাপুকুর বা মহীপালের কীর্তি হতে সামান্য উত্তরে মাহীসন্তোষ দুর্গ স্বাধীনতা উত্তোর কালে নব্বইয়ের এর দশক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। রংপুর এলাকা থেকে আগত পরিযায়ী শ্রমিকরা এই প্রত্নসম্পদটি বিনষ্ট করে বসত বাড়ি নির্মাণ করেছে । নতুনভাবে গড়ে উঠা গ্রামটি ক্রমশঃ জনবহুল গ্রামে রূপান্তরিত হচ্ছে।
মাহিসন্তোষ গড়ের প্রত্নতত্ত্ব বিশ্লেষণ
অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে টিলা সাদৃশ্য এই প্রত্নস্থলকেই মাহীসন্তোষ গড় নামে অভিহিত করা হয়। এই গড়ের আয়তন উত্তর-দক্ষিণে ২২৫ (দু'ই শত পচিশ) মিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৭৫ (একশত পঁচাত্তর) মিটার প্রায়। আয়তাকার দুর্গটি সুউচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। দূর্গটিকে সুরক্ষিত করার পরিকল্পনায় আত্রাই নদীকে এর উত্তর এবং পশ্চিম দিক বিবেচনায় রেখে পূর্ব ও দক্ষিণে গভীর পরিখা খনন করে দুর্গটির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছিল। পূর্ব দিকের পরিখাটি ভরাট হয়ে প্রায় সমতল ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণ দিকে অবস্থিত পরিখাটিতে বর্ষা কালে এবং বান- বন্যায় জলপ্রবাহের আধিক্য থাকায় সেটির অপেক্ষাকৃত ক্ষীণকায় অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান আছে। এই প্রত্নস্থল থেকে উদ্ধারকৃত একটি জীর্ণ কামান ও কয়েকটি তরবারি কলিকাতা জাদুঘরে এবং রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরে অনুরূপ একটি কামান সংরক্ষিত আছে।
সম্পত্তির পরিমাণ
স্থানীয় জনশ্রুতি থেকে জানা যায় উনিশ শতকেও মাহিসন্তোষের মসজিদ, মাদ্রাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ২৭৫০ (দুই হাজার সাতশত পঞ্চাশ) বিঘা লাখেরাজ সম্পত্তি ছিল। বলা বাহুল্য যে, মুসলিম যুগে এমন অনুদানের পরিমাণ ছিল আরো অনেক বেশি। মাহীসন্তোষের ক্ষমতা হ্রাস: আবার এই শহরটির অবনমনও শুরু হয় একই কারণে। বাংলায় মুসলিম রাজ্যের সীমানা বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং রাজধানী স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে মাহিসন্তোষ দুর্গের গুরুত্ব হ্রাস পায়।
১৫৭৫ সালে গৌড়ে মহামারীতে হাজার হাজার মানুষ মারা যাওয়াতে সুবাদার মুমিন খাঁন গৌড় থেকে তান্ডায় রাজধানী স্থানান্তর করেন। পরবর্তী সময়ে এখান থেকে রাজমহলে এবং আরো পরে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। ষোল শতকের শেষের দিকে অনেকাংশে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে শহরটি। রাজধানীর সঙ্গে দূরত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বারবকাবাদ শহরের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে হ্রাস পায়। অবশ্য এ সময়ে শহরটি একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এটি মোটামুটিভাবে মোগল যুগ পর্যন্ত টিকে ছিল।
মোগল ঐতিহাসিক আবুল ফজলের বর্ণনায় বারবকাবাদ শহরের উল্লেখ রয়েছে। উল্লেখ্য যে, সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহের শাসনামলে মাহিসন্তোষ প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদায় উন্নীত হয়ে বারবকাবাদ নামে পরিচিতি লাভ করে। সম্রাট আকবর বারবকাবাদকে বাংলা সুবার অন্যতম সরকারের মর্যাদা দেন মাহিসন্তোষ কেন্দ্রিক এ সরকার দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত ছিল।
নবাব মুর্শিদকুলি খান রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় সংস্কার আনয়নের জন্য ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সুবাকে ১৩ টি চাকলায় এবং ১৬৬০টি পরগনায় বিভক্ত করেন। এতে বারবকাবাদ পরগনার কোন উল্লেখ নাই। পরবর্তীকালে সম্ভবত মোগল যুগের শেষ ভাগে মহামারী বা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে শহরটি পরিত্যক্ত হয়।
স্থাপত্য
২.২৫ মি বিশিষ্ট পুরু দেওয়াল আয়তাকার মসজিদটির চারকোণে চারটি অর্ধ অষ্টভুজাকার পার্শ্ববুরুজ ছিল। ইট এবং পাথর দিয়ে নির্মিত এগুলি। ইট দিয়ে নির্মিত মসজিদের ভেতর আর এর বাইরের দেওয়ালের সামনের দিক পাথরের ফলক দ্বারা আবৃত করা। মসজিদে প্রবেশের জন্য সম্মুখভাগে পাঁচটি প্রবেশপথ ছিল। খুব সম্ভবত কেন্দ্রীয় প্রবেশপথটি পাশের প্রবেশ পথগুলি অপেক্ষা বৃহদাকারের ছিল।
তিনটি করে প্রবেশ পথ ছিল উত্তর ও দক্ষিণের প্রতি দিকে। প্রতি সারিতে চারটি করে দুই সারি প্রস্তর স্তম্ভের সাহায্যে মসজিদের অভ্যন্তর ভাগ বিভক্ত করা হয়েছিল। ঘনক আকৃতির পাথরের ভিত্তির উপর প্রতিটি স্তম্ভ ছিল দন্ডায়মান। বর্গাকার প্রতিটি স্তম্ভের দন্ড তিনটি অংশে বিভক্ত। সর্বনিম্নের অংশের পরিমাপ ০.৪০ মি এবং এর গায়ে ছিল ত্রিকোণাকার নকশা। মাঝের অংশের পরিমাপ ১.৫৫ মি।
এখানে শিকল এবং ঘণ্টার নকশা দেখা যায়। সবচেয়ে উপরের বহুভুজ আকৃতির অংশটির পরিমাপ ০.৯৬ মি। এই অংশে শিকল ও ঘণ্টার নকশা এবং অর্ধ বৃত্তাকার ঝুলন্ত মুক্তার নকশা রয়েছে। মসজিদের কেন্দ্রীয় ‘নেভ’ পাশের অংশ অপেক্ষা বড় এবং তিনটি আয়তাকার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। এগুলির ছাদ সম্ভবত বাংলা চৌচালা রীতির খিলান ছাদে আচ্ছাদিত ছিল। আর এর দুপাশের অংশ দুটি সম্ভবত আচ্ছাদিত ছিল সর্বমোট ১২ (বারো) টি অর্ধগোলাকার গম্বুজে।
আচ্ছাদনের এই ব্যবস্থা বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সম্মুখভাগের প্রবেশ পথের সমান্তরালে কিবলা দেওয়ালে রয়েছে পাঁচটি মিহরাব। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি পাশেরগুলি অপেক্ষা সামান্য বড়। মিহরাবটি বর্তমানে বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। মূলত এই মিহরাবটি একটি পাথরখন্ড দিয়ে নির্মিত এবং সুন্দর অলংকরণে সজ্জিত।
শিকল ও ঘণ্টা, পদ্ম এবং তালপত্র নকশা (Palmette) প্রধান মোটিফ হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। উত্তর দিকের শেষ মিহরাবটির অভ্যন্তরে সুন্দরভাবে খোদাইকরা নকশা এখনও দৃশ্যমান। এটি দেখে মনে হয় পাথরের তিনটি টুকরো দিয়ে এটি নির্মিত। মিহরাবের কুলুঙ্গির কেন্দ্রীয় অংশ শিকল এবং ঘণ্টা নকশায় অলংকৃত। শিকল নকশার পাশে একটি ঝুলন্ত পুতির মালার নকশা ছিল। শিকল নকশার নিম্নাংশে ছিল ঝুলন্ত প্রস্ফুটিত পদ্মের নকশা।
পাথরের টুকরাগুলির পার্শ্ববর্তী প্রান্তে গোলাকার এবং বর্গাকৃতির জ্যামিতিক নকশা আছে। মিহরাবের উপর এবং নিম্নভাগে সংযুক্ত গোলাপ নকশা এর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এখানে ব্যবহূত শিকল এবং ঘণ্টার নকশার সঙ্গে দরসবাড়ি মসজিদ, ছোটসোনা মসজিদ এবং কুসুম্বা মসজিদ এর শিকল ও ঘণ্টা নকশার ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। মসজিদের আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা পাথরখন্ডের গায়ে অলংকরণের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়।
এই অলংকৃত পাথরখন্ড প্রমাণ করে যে, মসজিদের বাইরের দেওয়ালে পাথরে খোদাই করা অলংকরণ ছিল। আলংকারিক অংশগুলি মূলত জ্যামিতিক আকারের ফুলের নকশা, তালপত্র, খোটা, ত্রিভুজাকৃতির, প্যাঁচানো, শিকল ও ঘণ্টার নকশা এবং অর্ধবৃত্তাকার ঝুলন্ত হারের নকশা প্রভৃতি মোটিফ দিয়ে অলংকৃত ছিল।
এখান থেকে বেশ কিছু পোড়ামাটির অলংকৃত ফলকের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। গম্বুজের ড্রামের অভ্যন্তরে অলংকরণ হিসেবে এই পোড়ামাটির অলংকৃত ফলক ব্যবহূত হয়েছে। অলংকরণের এই পদ্ধতিও দরসবাড়ি, ছোটসোনা এবং কুসুম্বা মসজিদ এ দেখা যায়। বহিঃস্থ নকশা, অন্তঃস্থ্য নকশা।
বাংলাদেশের হারিয়ে যাওয়া মুসলিম নগরীর স্মৃতি স্মারক মাহীসন্তোষ মসজিদের ধ্বংসাবশেষ
এই প্রত্নস্থল উৎখনন করতে গিয়ে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি একটি শিলালিপি আবিষ্কার করে। এই শিলালিপি হতে জানা যায় যে, আলাউদ্দীন হোসেন শাহ ৯১২ হিজরি/১৫০৬ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল। অতি সম্প্রতি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে নেওয়ার সময় আরেকটি শিলালিপি পাওয়া যায়। বর্তমানে এটি নতুন করে নির্মিত কাঁচা মসজিদের সম্মুখে স্থাপিত রয়েছে। শিলালিপিটি দুই সারিতে কালো কষ্টি পাথরে খোদাই করা।
এটি সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহের আমলে ৮৬৭ হিজরি/১৪৬৩ খ্রিস্টাব্দে জনৈক উলুগ খান হাসান কর্তৃক একটি মসজিদ নির্মাণের স্মারক। দুটি শিলালিপি থেকে ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদটির নির্মাণকাল সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়- মসজিদটি কি সুলতান বারবক শাহ এর আমলে, নাকি আলাউদ্দীন হোসেন শাহ এর আমলে নির্মিত; এটি কি সুলতান বারবক শাহের সময়ে নির্মিত এবং আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সময়ে পুনঃনির্মাণ করা হয়েছিল।
এই দুটির মধ্যে একটি শিলালিপি কি বাইরে থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিল এবং এটা কি মসজিদের ভিতরের সুরক্ষিত অবস্থায় রাখা ছিল? উপরিউক্ত কোন সম্ভাবনার পক্ষে যুক্তি দেখানোর উপায় নেই। তবে এটা খুবই সম্ভব যে [সুলতান আহমেদ] মাহীসন্তোষ মসজিদ নওঁগা জেলার ধামইর হাট থানা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিমি উত্তর-পশ্চিমে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায় অবস্থিত।
প্রাক মুসলিম আমল হতেই পরিচিত ঐতিহাসিক মাহীসন্তোষ এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এর আমলে। এখানে একটি টাকশাল স্থাপন করেন সুলতান রুকনুদ্দীন বারবক শাহ এবং এটি পরিচিতি লাভ করে তাঁর বারবকাবাদ নামানুসারে। এখনও অনেকগুলি প্রত্নতাত্ত্বিক সম্ভাবনাময় এই শহরটির বিভিন্ন অংশে ঢিবি দেখতে পাওয়া যায়।
মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ ১৯১৬ সালে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি এই ঢিবিটিতে উৎখনন করে। সেই সময় উন্মোচিত হয়েছিল মসজিদটির কিছু অংশ। বরতমানে স্থানীয় লোকজন জঙ্গল ও ঢিবির ধবংসাবশেষ সরিয়ে সেখনে পুরানো সেই মসজিদটির উপরে জুমার নামায পড়ার উদ্দেশ্যে চৌচালা টিনের ছাদে আবৃত একটি মসজিদ নির্মাণ করেছে। এই কারণে টিকে থাকা বৈশিষ্ট্য হতে এই মসজিদের আদি পরিকল্পনা সম্পর্কে ধারণা করা সম্ভব।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url